eaibanglai
Homeএই বাংলায়ঘোর বৈষ্ণব পরিবারে কীভাবে প্রতিষ্ঠা পেলেন সবুজকালী মা? জানুন সেই ইতিহাস!

ঘোর বৈষ্ণব পরিবারে কীভাবে প্রতিষ্ঠা পেলেন সবুজকালী মা? জানুন সেই ইতিহাস!

সঙ্গীতা চৌধুরীঃ- আজকে কৌশিকী অমাবস্যার দিন জেনে নেবো হুগলির সবুজ কালী মায়ের মন্দিরের ইতিহাস। এই মন্দির এতটাই জাগ্রত যে, ভক্তিভরে এখানকার মাকে স্মরণ করলেই সকল মনস্কামনা পূরণ করেন মা। আর্থিক কষ্ট থেকে শুরু করে সন্তান লাভ সবই সম্ভব মায়ের কৃপায়। হরিপালের শ্রীপতিপুর পশ্চিম গ্রামের‌ অধিকারী পরিবারে রয়েছে এই সবুজ কালী মায়ের মন্দির। মা এখানে করালবদনা, মুক্ত কেশী, চতুর্ভুজা, মুণ্ডমালা ভূষিতা, তবে মায়ের গাত্রবর্ণ সবুজ। কেন শাস্ত্র মত মেনে মায়ের গায়ের রং এখানে নীল বা কালো নয়? ঘোরতর বৈষ্ণব এই পরিবার, যেখানে আজও নারায়ণ পূজিত হন, সেখানে কীভাবেই বা দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন বটকৃষ্ণ অধিকারী? সবটাই এক অলৌকিক ইতিহাস।

এবারের কৌশিকী অমাবস্যায় মায়ের সাজ

শুনে নেবো মন্দির প্রতিষ্ঠার সেই অলৌকিক ইতিহাস বটকৃষ্ণ অধিকারীর পৌত্র, সবুজ কালী মায়ের মন্দিরের আহ্বায়ক দেবজ্যোতি অধিকারীর মুখ থেকে। তিনি জানান, তার দাদু মানে স্বর্গত শ্রী শ্রী বটকৃষ্ণ অধিকারী ঠাকুর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন এই মন্দির প্রতিষ্ঠার বিষয়ে। দেবজ্যোতি অধিকারীর কথায়,“আমাদের হচ্ছে গোরা বৈষ্ণব পরিবার, আজ থেকে ৭৪ বছর আগে দাদু তখন এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার আগে দাদুর যখন অল্প বয়স ছিল, তখন উনি পড়াশোনা কমপ্লিট করে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করার পর উনি রাজস্থানের একটি জায়গায় চাকরি করতেন। যেহেতু আমাদের ভীষণে গ্রাম্য পরিবেশ এবং আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাও সে সময় ভালো ছিল না, একটা রোজগারের খাতিরে দাদু সে সময় চাকরির জন্য চলে যান,তারপরে একটা সময় যখন পাকিস্তান ভাগ হয় , তখন দাদুকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয় লাহোরে। তখন বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠরা মানা করেন, তখন দাদু চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে আসেন। এসে , তিনি মাঠে চাষাবাদ শুরু করেন তবে আমাদের সে সময় নির্দিষ্ট কোন জমি ছিল না অন্যের জমিতে তিনি চাষ আবাদ করতেন। সেই সময় তিনি মাঠে জমি চাষ করতেন আর বাঁশি বাজাতেন আর নিজের আপন খেয়ালে থাকতেন। দাদু বিয়েও করতে চাননি, জোর করে তার বিয়ে দেওয়া হয় সেই সময়। তবে বিয়ে দেওয়ার পরেও দাদুর সংসারী মতিগতি ফেরে না, তিনি বেশিরভাগ সময় মাঠে-ঘাটেই পড়ে থাকতেন। গ্রামের মাঝখানে একটি শ্মশান আছে সেখানেই তিনি বেশিরভাগ সময় পড়ে থাকতেন। এর মধ্যে এমন একটা দিন আসে, যখন তিনি মাঠে গরু নিয়ে গিয়েছিলেন ও বাঁশি বাজাচ্ছিলেন,তখন সাদা পোশাক পরা একজন সন্ন্যাসী তাকে ডেকে বলেন, তোমার সাধক হ‌ওয়ার লক্ষণ রয়েছে, তুমি আমার সাথে শ্মশানে, ওমুক গাছের নীচে আমার কুটির আছে, সেখানে দেখা করবে, তোমাকে দীক্ষা দেবো। এটা শুনে দাদু চমকে যান,পরে দাদু তার মায়ের অনুমতি নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। এরপরেই দাদু নির্দিষ্ট সেই গাছের নীচে গিয়ে দেখেন সেখানে একটি কুটির রয়েছে, যা দেখে দাদু অবাক হয়ে যান কারণ তিনি এত কালেও সেই কুটির কখনো দেখেননি। পরে দাদু ওনার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন, তার পরের ঘটনা আমরা কেউই জানি না। তা সবটাই গুপ্ত। তবে পরবর্তীকালে তিনি লুকিয়ে শ্মশান সাধনা করেছিলেন। আসলে আমাদের পূর্বপুরুষ দাদুর বাবা থেকে শুরু করে প্রত্যেকে‌ই রাধা গোবিন্দের নাম থেকে শুরু করে তিলক সেবা করতেন আর নিরামিষ ভোজন করতেন। দাদুর বাবা তো মাঠের ধারে যে জায়গায় পিঁয়াজ চাষ হতো, সেই আল দিয়েও হাঁটতেন না, এতটাই কৃষ্ণ ভক্তি ছিল তার। তাই দাদুকে লুকিয়েই তন্ত্র সাধনা করতে হয়েছিলো। একটা সময় শ্মশান সাধনা করতে করতে ওনার সিদ্ধি লাভ হয় এবং বিশেষ কিছু ক্ষমতাও তিনি পেয়ে যান। এরপর নিজের ঘরের মধ্যে একটি ঘট প্রতিষ্ঠা করে তিনি পুজো করতে শুরু করেন”।

এরপর বাংলার ১৩৫৭ সালে বটকৃষ্ণ অধিকারীকে মা স্বপ্ন দেন,“আর কতকাল ঘটে পুজো করবি? এবার আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা কর।” বটকৃষ্ণ অধিকারী তার সেই স্বপ্নাদেশের কথা সকলকে বললে সমাজের মোড়লরা বলেন, যেহেতু তারা বৈষ্ণব, তাই তারা কিছুতেই কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না, তাদের প্রতিষ্ঠা করতে গেলে কৃষ্ণমূর্তিই‌ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেদিনের সমাজের প্রবল বাধা, পরিবারের বাধাকে পরবর্তীতে দৈব কৃপার ফলেই হেলায় এড়াতে পেরেছিলেন বটকৃষ্ণ অধিকারী।

দেবজ্যোতি অধিকারী বলেন,“এরপরেই দাদু পুনরায় স্বপ্নে দেখেছিলেন,অথবা হয়ত শ্মশানে স্বয়ং দেখেছিলেন এটা ঠিক আমার জানা নেই, দাদু দেখেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ ও মা কালী একত্রে তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তুমি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করো, কিন্তু মূর্তির মুখটা হবে এইরকম। তখন দাদু দেখেন, কৃষ্ণ ও কালী একসঙ্গে একই দেহে মিলিত হয়ে গেলেন। মানে একই অঙ্গে হয়ে গেলেন, হয়ে গিয়ে একটি নারী মূর্তি তৈরি হলো, যেটা কালীর মতো দেখতে কিন্তু গায়ের রং সবুজ। আমাদের মায়ের যখন রং করা হয় দুর্বার ঘাসের উপরে যে কচি অংশটি সেই রং মিলিয়ে মায়ের গায়ের রং এখনো নির্বাচন করা হয়। যখন মায়ের অঙ্গরাগ হয়, সেই রূপটি দাদু বাংলার ১৩৫৭ সালের রটন্তী কালী পুজোর দিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।”

সেই থেকেই দেবী এখানে নিত্য পূজা পেয়ে আসছেন, দেবীর পুজো হয় এখানে গুহ্যতন্ত্র মতে। দেবী পূজার আসন রূপে রয়েছে পঞ্চমুন্ডির আসন, তবে বৈষ্ণব পরিবারে বলি প্রথা নিষিদ্ধ। এখানে মাকে যেমন কপালে তিলক পরানো হয়, তেমনি মায়ের ভোগে আমিষ খাবারও নিবেদন করা হয়, আবার নিয়ম করে মাকে বাঁশি বাজিয়ে‌ও শোনান মন্দিরের সেবায়েতরা। বর্তমানে বটকৃষ্ণ অধিকারের পুত্র কালীপদ অধিকারী মন্দিরের প্রধান সেবায়েত হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments