সঙ্গীতা চ্যাটার্জী (চৌধুরী)ঃ- শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু রাধা ভাব অর্থাৎ গোপীভাব অবলম্বন করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাহিরে কৃষ্ণ অন্তরে রাধা ছিলেন। তাই পথে পথে তিনি হা কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ বলে ছুটে বেড়াতেন। এখন প্রচুর মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠে যে কেন চৈতন্য মহাপ্রভু গোপীভাব অবলম্বন করেই জন্মগ্রহণ করলেন? তার উত্তর একটাই শ্রীকৃষ্ণের যত ভক্ত আছে তাদের মধ্যে রাধারানী শ্রেষ্ঠ, গোপীভাবই শ্রেষ্ঠভাব। এখন রাধা প্রেম অথবা গোপীভাবের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসে, তাদের মনের সেই শঙ্কা নিবারণ করবার জন্য চলুন আজকে একটি গল্প বলি।
একবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের খুব কঠিন একটি অসুখ হল। অসুখ এতটাই কঠিন যে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। দ্বারকার সব বড় বড় বৈদ্য কবিরাজদের ডাক পড়লো। কিন্তু তারা কেউই পারলেন না ভগবানকে সুস্থ করে তুলতে। আসলে ভগবানের লীলা যে ছিল অন্য! তাই সকলেই ব্যর্থ হলেন। এই খবর যখন ভক্ত শ্রেষ্ঠ নারদ মুনির কানে গিয়ে পৌঁছল তখন তিনি দৌড়ে ছুটে এলেন দ্বারকায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পায়ে হাত দিয়ে বললেন , “প্রভু আপনি লীলাময়, আপনিই জগতের পালক, আপনার কৃপায় সমগ্র জীবজগত সুস্থ থাকে, আপনাকে সুস্থ করার ওষুধ অন্য কেউ কীভাবে দিতে পারবে! আপনি নিজেই বলুন, কিভাবে আপনি সুস্থ হবেন।”
মুচকি হেসে লীলাধর তখন বললেন, “নারদ এ তো খুব সহজ! আমাকে যিনি ভালোবাসেন, এমন যে কোনো একজন ব্যক্তির পদধূলি এনে আমার কপালে ছুঁইয়ে দিলেই,আমি সেরে উঠব।” উত্তর শুনে নারদ বললেন, “বাহঃ এত খুব সহজ ব্যাপার! আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি ”-এখানে ভাববার বিষয় নারদ মুনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভক্ত বলে দাবি করেন। কিন্তু তিনি নিজের পায়ের ধূলি দিলেন না। তিনি পায়ের ধূলি আনতে ছুটলেন, কারণ তার ভগবানের কপালে যদি তিনি নিজের পদধূলি দিতেন তাহলে যে তিনি মহা পাপের ভাগী হতেন! পাপের ভয়ে তিনি নিজের পদধূলি দিলেন না, তিনি ছুটলেন মাতা রুক্মিণীর কাছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সুস্থতার জন্য রুক্মণীর কাছে পদধূলি চাইতেই আঁতকে উঠলেন রুক্মিণী! স্বামীর মাথায় নিজের পদধূলি দিলে যে মহাপাপ হয়, অনন্ত নরক বাস হয় তাই তিনি এই কাজ করতে পারলেন না! – ব্যর্থ হয়ে নারদ মুনি শ্রীকৃষ্ণের সকল পত্নীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেন, শেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আত্মীয় পরিজনের কাছেও ছুটলেন কিন্তু কেউই মহাপাপের ভাগী হতে রাজি হলেন না।
কোথাও যখন পদধলি পেলেন না তখন নারদ মুনি ছুটে গেলেন বৃন্দাবনে, রাধারাণীর কাছে। সব কথা শুনে এতোটুকু সময় নষ্ট না করে রাধারানী নিজের আচল পেতে তার মধ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন তার চরণ ধুলি দেওয়ার জন্য, তারপর সেই ধুলি নারদের হাতে দিয়ে নারদ মুনিকে তিনি বললেন, আর দেরি করবেন না তাড়াতাড়ি যান।
- প্রস্থান করবার আগে নারদ মুনির রাধারানীকে প্রশ্ন করলেন, “হে দেবী আপনার কাছে আমার একটি প্রশ্ন আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পত্নীগণ থেকে শুরু করে তার আত্মীয় স্বজন সকলেই তাকে ভালোবাসেন। তবু প্রত্যেকেই পাপের ভয়ে আমায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনার কি পাপের ভয় নেই? নরকযন্ত্রণার ভয় নেই? কীভাবে অনায়াসে আপনি এ কাজ করতে পারলেন?”
রাধারাণী তখন হেসে বললেন, “শ্যাম আমার প্রাণাধিক প্রিয়, তাকে সুস্থ করতে আমি আমার জীবনও দিতে পারি, তাকে সুস্থ করতে গিয়ে যদি নরকভোগ হয় সে আমার কাছে স্বর্গসুখের থেকেও বেশী! তাকে ছাড়া এই জীবনই তো নরক যন্ত্রণার চেয়েও বিষম!”
নারদ ফিরে এলেন দ্বারকায়, রাধারাণীর চরণধূলি মাথায় ছোঁয়াতেই সেরে উঠলেন লীলাধর শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু সকলের মন থেকে সন্দেহ মুছে গেলো, কেন গোপীভাব শ্রেষ্ঠ? কেন রাধার প্রেম শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে আর কারোর মনে কোন প্রশ্ন থাকলো না। রাধে রাধে, হরে কৃষ্ণ।