মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:– ফের শুরু ‘আড্ডা’র ‘প্রচেষ্টা’ ক্লাব ভাঙ্গার প্রচেষ্টা। সরকারি জায়গা জবরদখল করে, রাস্তার উপর গড়ে ওঠা সিটিসেন্টারে বিলাসবহুল ওই ক্লাবঘর ভেঙে দেওয়ার জন্য ফের একবার নোটিশ সাঁটিয়ে, লাল ক্রস এঁকে এডিডিএ পক্ষপাতহীন জবরদখল উচ্ছেদের উদ্যোগ নিতেই ফোঁস করে উঠেছেন ক্লাবটির পৃষ্ঠপোষক কিছু ব্যবসায়ী, এমনকি খোদ এডিডিএ’তে দুপুর দুপুর আড্ডা দিতে যাওয়া এক নতুন পদাধিকারী। আর তাই নিয়েই আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেছে ভাঙার দায়িত্বে থাকা এডিডিএ প্রশাসন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে শহর দুর্গাপুরের বিধাননগর সহ কয়েকটি জায়গায় জবরদখল উচ্ছেদ অভিযান চালায় আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এডিডিএ)। সেই অভিযানের পরপরই প্রশ্ন ওঠে- শহরের অন্য সব জায়গায় ভাঙাভাঙি চালালেও, নিজের দপ্তরের ৩০ মিটার দূরত্ব থেকে শুরু করে সিটিসেন্টারে চতুরঙ্গ মাঠ পর্যন্ত লুট হয়ে যাওয়া সরকারি জমি উদ্ধারে বরাবরই কেন উদাসীন এডিডিএ? এরপরই বিজ্ঞপ্তি জারি করে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে বলে কয়েক ডজন দোকান ঘরের গায়ে লাল দাগ এঁকে সেবার কোনরকমে দায় সারে এডিডিএ। আবার সিটিসেন্টারেরই ‘জংশন মল’ সংলগ্ন এলাকার জবরদখল উচ্ছেদ করতে গিয়ে, কিছু সাধারণ হকারের দোকান, ঘুমটি হটিয়ে দিলেও সংস্থা একটি হোঁচট খায় জবরদস্ত। কারণ, সেখানেই সরকারি জমি দখল করে বছরের পর বছর বুক ফুলিয়ে ব্যবসা করছেন এডিডিএ’রই নতুন দায়িত্বে গর্বিত হওয়া এক হোটেল ব্যবসায়ী। সূত্রের খবর, তারই কলকাঠি নাড়ানোয় আচমকা হাত গুটিয়ে বসে পড়ে এডিডিএ। পাশাপাশি, চতুরঙ্গ মাঠ পর্যন্ত জবরদখলকারীদের দাগিয়ে দিলেও সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয় বিতর্কিত বিলাসবহুল ওই ক্লাবঘরটি।
বুধবার এডিডিএ গোটা সিটি সেন্টার এলাকায় মাইকিং করে জবরদখলকারীদের ৩১ জুলাই পর্যন্ত চরম সময়সীমা জানিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয় – ‘আর কোনো রেয়াত নয়, মালপত্র সরিয়ে না নিলে, এবার সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।’ এডিডিএ’র আচমকা এই বিজ্ঞপ্তিতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে ফুটপাতের ওপর ব্যবসা করা সিটি সেন্টারের হকারদের। হকারদের দাবি, “বিগত ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছি। আমরা তবে যাবো কোথায়?” এডিডিএ’র কড়া ইঙ্গিত, “৩০-৪০ বছর ধরে কে কি করছে তা দেখা সরকারি সংস্থার কাজ নয়। বেআইনি কাজটা চিরকালই বেআইনি, তা সে যতদিন ধরেই করুক। এভাবে আর আস্কারা দিয়ে কাউকে পুষে রাখা হবে না।”
এদিকে, বিলাসবহুল ‘প্রচেষ্টা’ ক্লাবঘরটিকে জবরদখলকারী চিহ্নিত করে দাগিয়ে দেওয়ায় বুধবার দুপুরের পর থেকেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে এলাকায়। রাজনৈতিকভাবে সিপিএম এবং বিজেপি সমর্থক সদস্যদের অন্যতম ঘাঁটি বলে চিহ্নিত ক্লাবঘরটিতে রাজ্যে পালাবদলের পর গুটিকয় তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থক আনাগোনা শুরু করলেও, ২০১৯’র লোকসভা এবং ২০২১’র বিধানসভা ভোটের আগে আগে বিরোধী শিবিরের পতাকা টাঙিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে ‘প্রচেষ্টা’ ক্লাব। বারবার কার স্বার্থে ‘প্রচেষ্টা’ ক্লাবটিকে কেনইবা তোয়াজ করা হচ্ছে- এ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে শাসকদলের অন্দরেই। আরেকটি সূত্র জানায়, “পাড়ার ছেলেদের আব্দারে এডিডিএ’র ভাইস চেয়ারম্যান মাঝে মাঝে যখনই রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তখনই সব থেমে যায় ভাঙার আয়োজন।”
নতুন করে ‘প্রচেষ্টা’ ক্লাবে জবরদখলকারী হিসেবে লাল দাগ আঁকতে গিয়ে বুধবার থমকে যান এডিডিএ’র এক সহকারী নগর পরিকল্পনা আধিকারিক। কারণ, এডিডিএ দপ্তর থেকেই নাকি তার কাছে একটি ফোনে ওই ক্লাবঘরটি বাঁচিয়ে অন্যসব দখলদারদের চিহ্নিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বলা হয়, “ভাইস চেয়ারম্যান সাহেব ক্লাবটিকে ছাড় দিতে বলেছেন।” এ নিয়ে দপ্তরে শোরগোল পড়তেই স্বমহিমায় আসরে নামেন এডিডিএ’র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। জবরদখল চিহ্নিত করতে যাওয়া এডিডিএ কর্মীদের তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, “আমি চেয়ারম্যান বলছি। ওই ক্লাবে দাগ দিয়ে দিন। দরকার পড়লে উচ্ছেদ অভিযান ওখান থেকেই শুরু করবো। তারপর দেখছি।” এরপরই ‘প্রচেষ্টা’ বাঁচাতে যাওয়া লোকজনের উৎসাহের ফানুস কার্যত চুপসে যায়।
এদিকে, উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে ময়দানে বৃহস্পতিবার থেকে এমন এমন লোকজন আওয়াজ তুলতে শুরু করেছেন, যাদের বিরুদ্ধে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে সিটি সেন্টারে দখলদার বসানোর অভিযোগ রয়েছে। এরা কেউ কেউ আবার এক প্রাক্তন মেয়রের কোলের ছেলে। বিচারক আবাসনের এক পাম্প অপারেটরও এদিন বলেন,”হঠাৎ এই উচ্ছেদের নোটিশ। আমাদের মতো গরিব মানুষেরা যাবে কোথায়? আমাদের জন্য সরকার কিছু করুক।” তিনি একটি চাকরি করেন, আবার তিনি জবরদখলও করেন। অভিযোগ, তিনি নাকি দখলকারীও বসান। তেমনই অভিযোগ, সিটি সেন্টারে বাড়ি কেনা মায়া বাজারের এক লোহা মাফিয়া অবাঙালি পরিবারের বিরুদ্ধেও। ‘তৃণমূলের ভাই, বিজেপির দাদা’ ওই পরিবারের এক যুবক সিটিসেন্টার জুড়ে দেদার দোকানদার বসিয়ে মাসোহারাও নাকি আদায় করেন বলে অভিযোগ পুলিশ মহলে এবং পুরসভায়।