সঙ্গীতা চৌধুরীঃ- একবার একজন প্রশ্ন করেন, “বিভিন্ন সাধক নানান পথে সাধনা করেন। কিন্তু তারা জগতকে কী একইভাবে দেখেন? অথবা তাদের দেখার মধ্যে পার্থক্য আছে? কোন দৃষ্টি নিয়ে তারা সাধনা করেন?”
এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামী সোমেশ্বরানন্দ মহারাজ বলেন যে, “তাদের সাধনা-দৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য আছে। ভক্তের অ্যাপ্রোচ আর জ্ঞানমার্গীর সাধনা আলাদা। রাজযোগী এবং কর্মযোগীও তেমনি নিজের-নিজের পথে সাধনা করেন।”
এরপর মহারাজ ব্যাখ্যা করেন একজন ভক্ত এই বিষয়টাকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন? “তার মতে ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সবকিছু চলছে। তিনিই সব করছেন। তাই প্রতিকূল পরিস্থিতিও ঈশ্বরই এনেছেন ভক্তের সামনে। যেহেতু ঈশ্বর পরম করুণাময় সেহেতু এই বিপদ বা কষ্ট তিনি দিচ্ছেন ভক্তের মঙ্গলের জন্যই। এই খারাপ অবস্থার মধ্যেও লুকিয়ে আছে কল্যাণের রাস্তা। আজকের কষ্টটা তিনি দিচ্ছেন ভক্তের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যই। সাধকের ভক্তি, বিশ্বাস, নিষ্ঠা কতটা তা মাঝেমাঝে পরীক্ষা করেন ঈশ্বর। অতএব দু:খও ঈশ্বরের প্রসাদ। এভাবে ভাল-মন্দ সবকিছুর মধ্যেই তাঁকে অনুভব করার চেষ্টা করেন ভক্ত।”
একজন জ্ঞানীর দৃষ্টি ভঙ্গি আবার আলাদা,“জ্ঞানমার্গী দেখেন অন্যদৃষ্টিতে। তিনি বিচার করেন, ইন্দ্রিয়গুলির সীমিত শক্তি দিয়ে যে জগতকে তিনি দেখছেন সেটি জগতের আসল রূপ হতে পারেনা। অথচ বাইরের কোনোকিছুকে বুঝতে হলে ইন্দ্রিয় ছাড়া সম্ভব নয়। তিনি তাই বাইরের জগতের বদলে অন্তরজগত নিয়ে অনুসন্ধান করেন। কে দেখছে, কে শুনছে, এই প্রশ্নের উত্তর তিনি খোঁজেন। মনের মধ্যে কখনো খুশি কখনো দু:খ, এখন চিন্তা তো তখন আবেগ, এই রাগ তো আবার ভয়, আসছে যাচ্ছে। সবকিছুই সাময়িক, কিন্তু ভেতরে কে বসে এইসব অনুভব করছে? এমন কি বা কে আছে যে স্থির থেকে অপরিবর্তনীয় হয়ে সব কিছুকে দেখছে? এই স্থির সত্বাকে তিনি উপলব্ধি করেন সাধনায়।”
আবার “যোগী দেখেন যে কতগুলি ঘটনা ঘটে চলেছে এই জগতে। একে ভাল বা মন্দ বলছে তার মন। কিন্তু একই ঘটনাকে কেউ বলে ভাল কেউ মন্দ। এবং এটা তারা বলছে নিজের-নিজের মানসিক সংস্কার অনুযায়ী।
এই সংস্কারগুলি আবার মানুষ নিজেই তৈরি করে চিন্তা ও আবেগ অনুযায়ী, এবং সামাজিক প্রভাবেও। যোগী বুঝতে পারেন যে সংস্কার হলো রঙিন চশমা, এক-একজনের একেক রঙের। এই চশমা খুলে দেখলে তবেই সত্যকে দেখা বা অনুভব কড়া সম্ভব। এই সংস্কারগুলি প্রকাশিত হয় মনের ঢেউ অর্থাৎ চিন্তা ও আবেগ রূপে। যোগী তাই এই ঢেউগুলিকে থামিয়ে অনুভবের চেষ্টা করেন ভেতরের সত্বাকে। আর এভাবেই খুঁজে পান সত্যকে।’’
এরপর আসে কর্মযোগীদের কথা। মহারাজের কথায়, “কর্মযোগী বিশ্লেষণ করেন কাজকে। প্রতিটি কাজেরই এক নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বোঝেন যে মানুষ সব কাজে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনা নানা কারণে। যেমন পিতা হিসেবে তিনি সন্তানকে মানুষ করার চেষ্টা করেও অনেক সময় সফল হননা কারণ সন্তানেরও নিজস্ব ইচ্ছা থাকে, তাছাড়া বাইরের প্রভাবও কাজ করে। তবুও পিতা হিসেবে তাকে নিজের কর্তব্য করতেই হবে। এভাবে তিনি অনুভব করেন যে সব কাজের পরিণতি তার ইচ্ছামতো হয়না, হবেওনা। তার কর্তব্য হলো নিষ্কামভাবে কাজ করা। এভাবে কর্ম তিনি করেন কিন্তু ফলে আসক্তি কমতে থাকে। তিনি এভাবে স্বার্থচিন্তা থেকে মুক্ত হন। আর স্বার্থচিন্তা কমার সাথেসাথে তার অহংভাবও কমে যায়। ব্যক্তি-চেতনা থেকে ক্রমশ মুক্ত হতেহতে তিনি বিশ্বচেতনার সাথে এক হয়ে যান।”
মহারাজ সব শেষে বলেন,“এভাবে চার রকম সাধনা বা পথ আছে। এক-এক সাধক একেক পথে চলেন নিজের প্রবণতা অনুযায়ী। কিন্তু সবাই শেষে একই সত্যে পৌঁছেন। প্রতিটি পথেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকলেও স্বামীজি বলেছিলেন এগুলির মধ্যে সমন্বয় করার জন্য। একটি সাধনাকে প্রধান পথ করে অন্য ৩টিকেও সঙ্গে নিতে। এরফলে সাধনা যেমন একঘেয়ে হয়ে উঠবে না তেমনি কোনো বিশেষ পথে নিয়ে মতান্ধতার সৃষ্টি হবে না।”





