সঙ্গীতা চ্যাটার্জী:- কিছু কিছু রোগকে আগে থেকে শনাক্ত করা গেলে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়ে ওঠে, কিন্তু টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এই কথাটি একেবারেই খাটে না। কারণ এই রোগটা যে কোনো বয়সে, যে কারোর হতে পারে আর সবথেকে অবাক করার মতো বিষয় হলো এই যে, এই রোগের কোনো পারিবারিক হিস্ট্রি না থাকলেও সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে এই রোগ দেখা দিতে পারে! এই রোগের আরো একটি ভীতিপ্রদ দিক হলো এই যে, এই টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে কোন মুখে খাওয়ার ওষুধ থাকে না। একমাত্র ইনসুলিন injection নেওয়ায় এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা।
ছোট থেকে বুড়ো, সবারই এই রোগ হতে পারে যে কোনো সময়, এই রোগ নিয়ে আমরা কথা বলে ছিলাম, প্রযুক্তিপ্রিয় ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের ডাক্তার তাহের হোসেনের সাথে, যিনি নিজেও গত ২ দশক ধরে টাইপ ১ ডায়াবেটিস এর সঙ্গী। দীর্ঘক্ষণের আলোচনায় ডাক্তারবাবু আমাদের বললেন, “যখন কোনো বাচ্চার মধ্যে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস দেখা দেয়, তখন সমাজের মধ্যে তাকে একটা এক ঘরে করে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে শুধুমাত্র সেই মানুষটি বা শিশুটির মধ্যে ইনসুলিন তৈরি করার ক্ষমতাটা কমে গেছে ব্যস এইটুকুই, আর তাই তাকে বাইরে থেকে ইনসুলিন নিতে হচ্ছে! কিন্তু সমাজের মানুষ এটা বোঝে না, তাই সমাজের মধ্যে এই রোগ নিয়ে এই শিশুদের ও মানুষদেরকে নিয়ে নানান রকম বিরূপ ভাবনা গড়ে ওঠে, তাই আমরা জনসচেতনতা তৈরি করছি সেই ভাবনার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। ”
ডাক্তারবাবু আরও বলেছেন,“সব ডায়াবেটিস এক রকম না। আজ আমরা টাইপ ১ ডায়াবেটিস (T1D) নিয়ে আলোচনা করব, যেটা অনেক সময় ভুল করে বোঝা হয়। টাইপ ২ এর বিপরীতে, type 1 diabetes (T1D) ওজন বা জীবনযাত্রার কারণে হয় না। এটি এক ধরনের অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীর ভুল করে ইনসুলিন তৈরি করা কোষগুলোকে আক্রমণ করে, ফলে মানুষ তাদের রক্তের শর্করাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।”
টাইপ- ১-ডায়াবেটিসের সাথে বেঁচে থাকা মানে ২৪/৭ ঘন্টা ভারসাম্য রক্ষা করা-
ক। সবসময় মনিটরিং:-রক্তের শর্করার মাত্রা পরিমাপ করতে হাতে ছিদ্র বা কনস্ট্যান্ট গ্লুকোজ মনিটর ব্যবহার করা হয়, যা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
খ। ইনজেকশন:- শরীর যে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, তা প্রতিস্থাপনের জন্য দিনে কয়েকবার ইনজেকশন নিতে হয়।
গ। খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চা:- সাবধানে পরিকল্পনা করা হয় যাতে শক্তির মাত্রা স্থিতিশীল থাকে এবং স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
ঘ। সংক্রামক নয়:- T1D-এর কারো থেকে এটি ধরা যায় না।কোনো ফ্যামিলি history ছাড়াই টাইপ১ ডায়াবেটিস হতে পারে।
ঙ। চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু স্বপ্ন পূরণে বাধা দেয় না: T1D-এর সাথে মানুষেরা অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব অর্জন করে!আমাদের পরিচিত ক্রিকেটের ওয়াসিম আকরাম এই অসুখে আক্রান্ত আছেন।
T1D-এর প্রাথমিক লক্ষণগুলি যা লক্ষ্য করা উচিত:
১। অতিরিক্ত তৃষ্ণা ও প্রস্রাব: শরীর অতিরিক্ত শর্করা বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে।
২। ক্ষুধা বৃদ্ধি: ইনসুলিন ছাড়া, কোষগুলি খাবার থেকে শক্তি শোষণ করতে পারে না।
৩। অকারণ ওজন কমে যাওয়া: শরীর শক্তির জন্য পেশী এবং টিস্যু ভেঙে দেয়।
৪। ক্লান্তি: কোষগুলি তাদের প্রাথমিক শক্তি উৎস, গ্লুকোজ থেকে বঞ্চিত হয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে, T1D- এর চারপাশে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে, যার ফলে অযথা বিচার এবং একাকীত্ব হয়। মনে রাখবেন:
- T1D কোন দুর্বলতা বা ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়।
- T1D-এর সাথে মানুষেরা দায়ী এবং সতর্কতার সাথে তাদের স্বাস্থ্য পরিচালনা করে।
- সমর্থন এবং বোঝাপড়া অনেকটা পার্থক্য করতে পারে।
চলুন সচেতনতা বাড়াই, ভুল ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ করি এবং T1D কমিউনিটির প্রতি সমাজে একটা জাগরুকতা নিয়ে আসি।
আধুনিক প্রযুক্তি টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জীবন অনেক সহজ এবং স্বাধীন করে তুলছে!
ভাবুন একটু, কন্টিনিউয়াস রক্তের শর্করার মাত্রা দেখানো ছোট্ট ডিভাইস (CGM) যেন আপনআকে মুহূর্তে গ্লুকোজ দেখে দেয় , ইনসুলিন পাম্প এমনকি নিজে থেকে রক্তের শর্করার মাত্রা দেখে ইনসুলিন ঠিকমতো ছেড়ে দেয় (আর আঙুল ফুঁড়ে রক্ত পরীক্ষা করার ঝামেলা নেই!), আর মোবাইল অ্যাপগুলি আপনার স্বাস্থ্যের সব খবর জেনে রাখে এবং সমস্যা হলে এমনকি আপনার প্রিয়জনদের জানিয়ে দেয়।
এর মানে আরও ভালো নিয়ন্ত্রণ, কম চাপ, এবং জীবন উপভোগ করার স্বাধীনতা! চলুন, সবার জন্য এই প্রযুক্তিগুলি আরও সহজলভ্য করে দেওয়া হয়:
- ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা: আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন এবং এই প্রযুক্তিগুলি সম্পর্কে জানুন।
- সরকার: এই প্রযুক্তিগুলিকে সহজলভ্য করে তোলার জন্য উদ্যোগ নিন।
- সমাজ: এই প্রযুক্তিগুলির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ান এবং এর ব্যবহার সমর্থন করুন।
একসাথে আমরা টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ব্যবস্থাপনা সহজ, আরামদায়ক এবং সবার জন্য উপলব্ধ করে তুলতে পারি!