মনোজ সিংহ, অন্ডাল:– এগারোশ ছাত্রছাত্রী এখানকার একটি স্কুলে। আর সেই স্কুলেরই এক শিক্ষক প্রায় ৮০০ দিন ধরে স্কুলেই আসেন না, আবার এক শিক্ষিকা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এলেই নাকি নিয়ম ভেঙ্গে কানাডা চলে যান বছর বছর।
সারাটা বছর তাকেই নাকি ক্লাসরুমে কম আর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের ঘরেই কম্পিউটার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে বেশি দেখা যায়, বলে শিক্ষকদেরই অভিযোগ। অথচ, অন্ডাল উচ্চ বিদ্যালয়টির কম্পিউটার শিক্ষক রয়েছেন দু দুজন – অনীক নাগ এবং সৌরভ সরকার। ওই দুই কম্পিউটার শিক্ষকের চেয়ে বিতর্কিত ওই শিক্ষিকাকে দিয়ে নিজের রুমে বসিয়ে কাজ করানোতেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি সাহার নাকি আগ্রহ বেশি রকম, বলে ওই স্কুলেরই শিক্ষক শিক্ষিকারা তিন পাতার একটি অভিযোগপত্রে ছত্রেছত্রে উল্লেখ করেছেন। সেই অভিযোগ জমা পড়েছে আসানসোলের অতিরিক্ত জেলাশাসকের দপ্তরে। যার বিরুদ্ধে এখন এত অভিযোগ সেই মৃনাল সাহার বিরুদ্ধে মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় বেআইনিভাবে নীল বাতি গাড়ি নিয়ে দিনের পর দিন স্কুলে স্কুলে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগও কিন্তু ছিল। এবার সেই মৃণাল কান্তি সাহাকে নিয়েই তারই স্কুলের ১৫ জন অভিজ্ঞ শিক্ষক শিক্ষিকা গুচ্ছ গুচ্ছ গুরুতর অভিযোগ তুলে সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
অতিরিক্ত জেলাশাসকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের সহায়তায় যথাযথ তদন্ত করা হবে। তবে তদন্ত কবে শুরু করা হবে, তা যদিও জানা যায়নি।

আবার, বোর্ড পরীক্ষার আগে প্রতি বছর কানাডায় একমাস কাটাতে যাওয়া ইংরেজির শিক্ষিকা ত্রিপ্তি মন্ডল মৃনাল সাহার কাছ থেকে কোনো ধরনের বাড়তি সুবিধা পাওয়ার কথা সরাসরি অস্বীকার করে বলেন, “স্কুলে আমি কেমন পড়াই তার সার্টিফিকেট দেবে স্টুডেন্টরা, কোনো শিক্ষক কি বলল সেটা আমার কাছে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি ক্লাসে যাই কি না যাই সেটা দেখার জন্য ওনারা কি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন?” তার আরও ঝাঁঝের সাথে জবাব, “স্কুলে গিয়ে আমি আমার ডিউটি করি। স্কুল যা কাজ দেয়,সেটা করা আমার কর্তব্য। কেনো করি এর কৈফিয়ত আমি স্কুল কর্তৃপক্ষকে ছাড়া আর কাউকেই দিতে বাধ্য নই।”
এই তৃপ্তি মন্ডল আবার স্কুল সার্ভিস কমিশনের বিতর্কিত ২০১৬ ব্যাচের যোগ্য বিবেচিত একজন শিক্ষিকা, যার মেয়াদ কোর্টের নির্দেশে চলতি বছরের ডিসেম্বর অব্দি নির্ধারিত। এনিয়ে উনি অবশ্য বাড়তি কথা বলতে চাননি।
ওই স্কুলেরই সংস্কৃত শিক্ষক গোপাল কোড়া প্রায় ৮০০ দিন যাবৎ স্কুলেই আসেননা মেডিকেল লিভ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও। তার সন্তানের অসুস্থতার কারণেই নাকি তাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, বলে স্কুল সূত্রে জানা গেছে। এনিয়ে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য গৌরাঙ্গ দাস বলেন, “এতদিন ওনাকে কিছুই বলা হয়নি ঠিকই। তবে, এবার ওনার বেতন বন্ধের সুপারিশ করে জেলা স্কুল পরিদর্শকের দপ্তরে জানানো হয়েছে।” এদিকে, শাসক ঘনিষ্ঠ আরেক শিক্ষিকা যখন সন্তানের চিকিৎসার জন্য ছুটি চাইলেন, তখন মৃনাল সাহা নাকি মুখের ওপর নির্মম ভাবে বলেন, ‘ ওর কি হবে সেতো জানেন। ওর জন্য এতো ছুটি নেওয়ার কি আছে?’ তার সন্তানের ব্যাপারে মৃণালের এমন নিদানে স্তম্ভিত ওই শিক্ষিকা অন্যন্য সহকর্মীদের সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারও প্রশ্ন, “এতো ঔদ্ধত্য ওনার আসে কোত্থেকে?” তার সতীর্থদের প্রশ্ন – একজন শিক্ষককে ৮০০ দিন অনুপস্থিতি নিয়ে সামনাসামনি বলার হিম্মত নেই মৃণালের, আর এই শিক্ষিকাকে নরম ভেবে এমন করে কাঁদিয়ে দিলেন?
এদিকে অভিযোগকারী শিক্ষকেরা এবার কোনরকম রাখঢাক না করে সরাসরি মৃণাল কান্তি সাহার বিরুদ্ধে বিষোদগার উগড়ে দিয়েছেন। অন্ডাল উচ্চ বিদ্যালয় এর অভিজ্ঞ শিক্ষক সুমন শ্যাম বললেন, “ঐতিহ্যবাহী আমাদের স্কুলটিকে পুরোপুরি বরবাদির পথে ঠেলে দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মৃণাল সাহা বা তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের কয়েকজন। স্কুলের শৃঙ্খলা, পড়াশুনা সবই এখন শিকেই উঠেছে। আমাদের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কাছে বহুবার শিক্ষকেরা এসব নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন বটে কিন্তু লাভ হয়নি কিছুতেই। আমাদের আর কি করার থাকতে পারে?” তার মতো আরো অন্যান্য শিক্ষকদের ক্ষোভ – ‘গত তিন বছর ধরে এমন ম্যানেজিং কমিটিকে পুনর্বহাল করা হয়েছে যেখানে তিনজন শিক্ষক প্রতিনিধি থাকার নিয়মকে তুচ্ছ করে কোনো শিক্ষককেই রাখা হয়নি। এসব বলতে গেলেও ওরা ওসব কানে তোলে না। আসলে নামেই কমিটি সব কিছু চলে মৃণাল বাবুর ইচ্ছায়।’
জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি স্কুলকে দিন দিন এত অরাজকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন, কেনই বা খোদ শিক্ষকরাই স্কুলের অব্যবস্থা নিয়ে প্রকাশ্যে সরব হচ্ছেন, বা সরকারি হস্তক্ষেপ চাইছেন? অন্ডালে এসে জানা গেল – শুধু শিক্ষকরাই নন, স্কুলের পরিচালন ব্যবস্থা, সেখানকার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, এমনকি স্কুলেরই এক দিদিমণিকে নিয়ে বিরক্ত কিছু ছাত্র-ছাত্রী নাকি স্কুলের গেটে কুকথাও লিখে দিয়ে ছিল কিছুদিন আগে। সম্প্রতি আবার স্কুলটি নিয়ে অভিভাবকদের একাংশ স্কুলের ৭৫ বর্ষ বর্ষপূর্তির জন্য বরাদ্দ টাকার খরচের গরমিলের অভিযোগও তুলেছেন প্রকাশ্যেই। আবার শিক্ষকদের একাংশ পরীক্ষা ফান্ডের টাকা অন্যত্র ইচ্ছেমতন খরচ করার মতো গুরুতর অভিযোগও তুলেছেন। সমস্ত অভিযোগের তীর যে মৃনালের দিকে, তিনি দুদিন ধরে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার উৎসাহ দেখাননি। তবে, তার হয়ে ব্যাটিং করে গেছেন তারই ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং সদস্যেরা। কমিটির সভাপতি গোবিন্দ ভট্টাচার্য পেশায় পুরোহিত। স্কুলের লেখাপড়ার সাথে তার যোগাযোগ যে কম, তা নিজের মুখেই কবুল করলেন। স্কুলেরই শিক্ষকদের তোলা অভিযোগ সম্পর্কে তার আবার অন্যরকম যুক্তি। তিনি বলেন, “মৃনাল সাহা স্কুলের কিছু বরিষ্ঠ শিক্ষকের যখনতখন ইচ্ছেমতন ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন বলেই ওদের এখন রাগ। তাই ওরা এসব করছে।”
মৃণাল সাহা নিজে একজন বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক। তিনি ছাড়া ওই স্কুলে বাণিজ্য বিভাগের ক্লাস নেওয়ার জন্য আরেকজন শিক্ষকও রয়েছেন, যিনি আবার অবসর নেবেন কয়েক মাসের মধ্যেই। এরই মাঝে মৃণাল সাহার বিরুদ্ধে নিয়মিত ক্লাস না নেওয়ার মতো অভিযোগও জমা পড়েছে। অথচ ওই স্কুলের বাণিজ্য বিভাগের ফলাফল এবং নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির আগ্রহ স্কুলের অন্যান্য বিভাগকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। সেখানেই দিনের পর দিন ক্লাস অনিয়মিত হয়ে পড়া, বা একজন শিক্ষকের নির্ভরশীল হয়ে পড়ার পর অন্ডালের অভিভাবকদের একাংশও এখন রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
কেনো এমন হলো? কে এই স্কুলের ভবিষ্যতের কপালে গোবর লেপে দিচ্ছে? এর পেছনে কি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দায়ী, নাকি স্কুল শিক্ষা দপ্তরের উদাসীনতা, নাকি আঙুল ফুলে কলাগাছ ভারপ্রাপ্ত সাহার আচমকা বেড়ে যাওয়া ঔদ্ধত্যই এর নেপথ্য কারণ? অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অভিযোগে বলা আছে – মৃনাল সাহা বয়স্ক শিক্ষকদেরও অপমান করেন ইচ্ছে মতন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, মৃণালের মাথার ওপর কারো হাত আছে কি?
মৃনাল সাহাকে তিন বছর আগে ওই পদে বসানোর সুপারিশ করেন এলাকার বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাহলে কি বিধায়কের প্রশ্রয়েই মৃণালের এই ঔদ্ধত্য?
জানা গেল, ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক সেরকম নয়। এমনও জানা গেছে, মৃণালকে সিংহাসনে বসিয়ে এখন বেশ হাত কামড়াচ্ছেন বিধায়ক নিজেও। মৃনালকে নিয়ে বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠছে। অভিযোগপত্রও পেয়েছি। যেখানে জানানোর জানাচ্ছি এবার।”






