জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,দুর্গাপুরঃ- যখন কোনো বাঙালি অভিভাবক নির্লজ্জের মত গর্ব করে বলেন – আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা – তখন হয়তো তার মাথায় থাকেনা নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার, কাজ করার অধিকারের দাবিতে বাঙালি একদিন রাস্তায় নামে। সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র জাতি বাঙালি যে নিজের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে দ্বিধাবোধ করেনি। বাঙালিদের আন্দোলনের চাপে ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি ১৯৬১ সালের ১৯ শে মে দিনটিকে – আর এক ভাষা দিবস।
বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা বিধানসভার অধিবেশনে ‘অসমীয়া’ ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৬০ সালের ২৪ শে অক্টোবর প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। উত্তেজিত বাঙালিরা প্রতিবাদ জানালে আসামে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির বাঙালিরা ১৪ ই এপ্রিল ‘সংকল্প দিবস’ পালন করে।
১৮ ই মে আসাম পুলিশ আন্দোলনের তিন নেতা রথীন্দ্রনাথ সেন, বিধুভূষণ চৌধুরী ও নলিনীকান্ত দাসকে গ্রেপ্তার করে। ১৯ শে মে সকাল থেকেই শিলচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জে বাঙালিরা সরকারি কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, আদালতে পিকেটিং করে। শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পালিত হয় ‘সত্যাগ্রহ’। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য শুরু হয় এক অভূতপূর্ব লড়াই।
আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, কমলা ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সুকোমল পুরকায়স্থ – ১১ জন মাতৃভাষাপ্রেমী বাঙালি। তাদের রক্তে লাল হয়ে ওঠে বরাক উপত্যকার মাটি।
এই হত্যার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে আসামের বাঙালিরা। সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তাদের স্মরণে আজও আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ১৯ শে মে দিনটিকে ‘বাংলা ভাষা শহীদ দিবস’ হিসাবে পালন করে।
কিন্তু বাংলাভাষী মানুষের কাছে দিনটি যতটা গুরুত্ব পাওয়ার দরকার ছিল ততটা পায়নি। এই বাংলার অধিকাংশ মানুষের কাছে দিনটির গুরুত্ব আজও অজানা থেকেগেলেও দিনটির গুরুত্ব ভোলেনি পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরের ‘আন্তরিক’ সাহিত্য পত্রিকা গোষ্ঠী।
তাদের উদ্যোগে ১৯ শে মে সকালে শহরের বেশ কয়েকটি সাহিত্যচর্চা সংগঠনের সদস্যরা দুর্গাপুরের ভাষা শহীদ উদ্যানে (এডিশন পার্ক) একত্রিত হন এবং একটি আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘অমর উনিশে ভাষা শহীদ’-দের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
প্রভাতী শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় শতাধিক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা উদ্যানের ভাষা ‘শহীদ-স্মারক’-এ পুষ্প নিবেদন করেন এবং দীপ-ধূপ প্রজ্বলনের মধ্যে দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। নীরবতা পালনের পর শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। সেখানে ছিলনা হারমোনিয়াম বা আধুনিক সাউণ্ড সিস্টেম।
উপস্থিত সদস্যরা খালি গলাতেই পরিবেশন করেন সঙ্গীত, কেউ কেউ করেন কবিতা পাঠ। অনেকেই তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে আজকের দিনের গুরুত্ব শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন। বাংলা ভাষার বর্তমান অবহেলিত পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের কণ্ঠে ঝরে পড়ে আক্ষেপ। কিভাবে এই দিনটির গুরুত্ব আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা যায় সেটা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় শহরের সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষেরা ভবিষ্যতের কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
আজকের অনুষ্ঠানে উপস্হিত ছিলেন নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভাপতি মোহিত গাঙ্গুলী, প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড.বাসুদেব হাজরা, শিল্পায়ন নাট্য গোষ্ঠীর দীপক দে, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অমল গড়াই, গণতান্ত্রিক লেখক কলাকুশলী সমিতি বর্ধমান জেলা সম্পাদক সীমন্ত তরফদার, ‘কবিতার কলম’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক দুলাল চন্দ্র সরকার, স্নেহাশীষ মুখোপাধ্যায়, কৌশিক চ্যাটার্জ্জী, দিশারী মুখোপাধ্যায়, পায়েল পোল্ল্যে কাড়ার, স্মিতা ঘোষ, পাপিয়া চ্যাটার্জ্জী, সোনালি বক্সী, আন্তরিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদিকা অন্তরা সিংহরায় সহ শহরের আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
আন্তরিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদিকা অন্তরা দেবী বললেন – আজকের দিনের গুরুত্ব আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব রাজ্যের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা গোষ্ঠীকে নিতে হবে। তবেই হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা কিভাবে আত্মত্যাগ করেছিলেন। সেই ইতিহাস স্মরণ করে আমরা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হব। সেটাই হবে ভাষা-শহীদদের প্রতি প্রকৃত সম্মান জ্ঞাপন।