জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ– মা-বাবার একমাত্র সন্তান স্বপ্নদীপ। তার আরও ভাই-বোন থাকতেই পারত। এটা গুরুত্ব দেওয়ার মত কোনো ঘটনা নয়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে গ্রামের ছেলে পড়াশোনা করতে আসে শহর তথা দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানকার শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতেই পারেনা। তবুও ওর মাঝপথেই থেমে গেল স্বপ্ন, নিভে গেল দীপ। দায় কার?
এর আগেও এই রাজ্য সহ দেশের বিভিন্ন নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে বসবাসকারী অনেক ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ঝামেলা এড়াতে লোকদেখানি তদন্ত শুরু হয়েছে। বড়লোক বা প্রভাবশালী বাড়ির ছেলেমেয়েদের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠলে মাঝপথেই তদন্ত থেমে গেছে। অনেক সময় ছাত্র সংগঠনের তরফ থেকে চাপ আসে। মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলোও চাপ দিয়ে তদন্ত বন্ধ করে দেয়। ফলে সত্যি ঘটনা সামনে আসেনি। স্বপ্নদীপের ঘটনায় বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও শেষ পরিণতি কি হবে বলা কষ্টকর। হৈচৈ থেমে গেলে হয়তো এটারও তদন্ত মাঝপথে থেমে যাবে।
বর্তমান ঘটনায় যাদের নাম উঠে এসেছে তারা প্রত্যেকেই নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রবীণ’ প্রাক্তনী। দীর্ঘদিন আগেই প্রথাগত শিক্ষার পাঠ চুকে গেলেও তারা হস্টেলের রুম দখল করে আছে। ছেড়ে যাওয়ার নাম নাই। তারপর তাদেরই নেতৃত্বে র্যাগিংয়ের নামে নবাগতদের প্রতি চলে অমানুষিক অত্যাচার। Struggle for existence এর মত এই অসম অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে কেউ টিকে যায়, কেউ হেরে যায়। যেমন হেরে গেছে স্বপ্নদীপ।
ঠাট্টার ছলে কাউকে নিয়ে মজা করাকে র্যাগিং বলে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হস্টেলে নবাগত ছাত্রছাত্রীদের নিয়েই র্যাগিং করা হয়। কখনোই র্যাগিংকে কেন্দ্র করে মৃত্যুর ঘটনা শোনা যায়নি। হয়তো ঘটেছে, তখন সমাজ মাধ্যম না থাকায় সেগুলো সামনে আসেনি। তার মধ্যেও কিছু কিছু হস্টেলের র্যাগিংয়ের ঘটনা রীতিমত আতঙ্কের সৃষ্টি করত।
এখন প্রশ্ন হলো – দীর্ঘদিন ধরে এইসব ‘প্রবীণ’ প্রাক্তনীরা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে হস্টেলের রুম দখল করে আছে সেগুলো কি কর্তৃপক্ষ জানত না? এরা যদি হস্টেলের রুমে বসে উগ্রপন্থার চর্চা করত এবং পরে বড় কোনো নাশকতার ছক করত তার দায় কে নিত? মাঝে মাঝে এধরনের ঘটনার কথা তো শোনা যায়!
পাশাপাশি হস্টেলের রুমে মদ, গাঁজা, আফিম, চরস সহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্যের আমদানির কথা শোনা যায়। সঙ্গে আরও এক ‘ম’ আছে। যারা হস্টেলের দায়িত্বে আছেন নিশ্চয়ই তাদের অজ্ঞাতে এগুলো ঘটেনা! ‘ম’ ‘ম’ এর গন্ধে তাদের মন কি মাতোয়ারা হয়ে যেত! ফলে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে তাদের ভুল হয়ে যেত! কারণ যাইহোক ঘটনার প্রাথমিক দায়িত্ব হস্টেল সুপারের।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে তারা হলো নবীন ও প্রবীণ ছাত্র। সঙ্গে অধ্যাপকদের একাংশ থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন হস্টেল সুপারের পক্ষে কতটা কড়াকড়ি করা সম্ভব? যেখানে অতীতে একজন উপাচার্য হস্টেলের খোলা জায়গায় ছাত্র ও তাদের মদতদাতাদের দাপটে সিসিটিভি বসাতে ব্যর্থ হন সেখানে একজন সুপার কিভাবে সফল হবেন!
সুপারের উপরেও আধিকারিক আছেন? এঁদের অজ্ঞাতসারে কি হস্টেল রুম দখল ছিল অথবা হস্টেলে মাদক দ্রব্য আমদানি হতো? উনাদের কাজের যা চাপ থাকে তাতে এইসব বিষয়ে নজর দেওয়া সম্ভব নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনোই পুলিশের আগমন কাম্য নয়। মাদক দ্রব্য বাইরে থেকে যেত। সেটা নিশ্চয় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জানত। সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারত।
স্বপ্নদীপের ঘটনা নিয়ে যেভাবে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে সেটা কখনোই কাম্য নয়। হস্টেলের ভিতর উগ্র বাম রাজনীতি কারও অপচ্ছন্দের হতেই পারে। আইন দিয়ে তার মোকাবেলা করা যেতেই পারে। কালো পতাকা দেখানোর অপরাধে ছাত্রদের উপর বিরোধী দলনেতার দেহরক্ষীদের আক্রমণ কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। যদি ছাত্ররা বিরোধী দলনেতার উপর আক্রমণ করার চেষ্টা করে থাকে তার জন্য তো পুলিশ আছে। যদি কোনো বড় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে যেত তার দায় কে নিত? এরপর যদি অভিষেকের চলার পথে বিজেপির কর্মীরা তাকে কালো পতাকা দেখাল এবং তার দেহরক্ষীরা ব্যাপক লাঠিচার্জ করে তখন কেমন হবে?
মূল ঘটনা হলো যে হারিয়ে গেছে সেতো আর ফিরবেনা। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে আর কোনো স্বপ্নদীপ যেন হারিয়ে না যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মানহানি যেন নাহয়। বহুজনের কঠোর পরিশ্রমের ফসল এই সম্মান লাভ। এটা বজায় রাখার জন্য প্রশাসন সহ প্রত্যেককে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। দরকারে মাঝে মাঝে একটু কঠোর হতেই হবে।
হস্টেল জীবন সবসময় দুঃস্বপ্ন বহন করে আনেনা, সুখকর স্মৃতিও থাকে। হস্টেল জীবন শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় অনেককে চোখের জল ফেলতেও দেখা গেছে। র্যাগিংমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন সবার কাম্য তেমনি ছাত্রজীবনের স্বাভাবিক আনন্দটাও সবার কাম্য হওয়া উচিত। এরপর জীবনযুদ্ধের কঠিন লড়াইয়ে কে কোথায় হারিয়ে যাবে তার ঠিকানা নাই।
সুতরাং সবদিক বজায় রেখে স্বপ্নদীপরা যাতে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরতে পারে সেদিকে অবশ্যই ‘সিনিয়র’ ছাত্রদের নজর দিতে হবে। রাজনীতি করার জন্য বিশাল ময়দান তো পড়ে আছে।