মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- গোটা রাজ্য, দেশ তথা বিশ্বজুড়ে সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে শ্রী শ্রী প্রভু জগন্নাথ দেবের শুভ রথযাত্রা উৎসব। এবছর রাজ্য সরকারের উদ্যোগে দীঘায় নবনির্মিত শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের মন্দির থেকে প্রথমবার রথের দড়িতে টান দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সারা রাজ্যের মানুষকে এই রথযাত্রা উপলক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর শুভেচ্ছা ও প্রভু শ্রী জগন্নাথ দেবের মহাপ্রসাদ বিতরণ শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই।
প্রতিবছরই শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরে বেশ কয়েকটি বড় রথযাত্রার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো এম এ এম সি মামরা বাজার সংলগ্ন জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রার উৎসব, ইস্পাত নগরীর চিত্রালয় মেলা ময়দানে অনুষ্ঠিত রথযাত্রা উৎসব ও মহামিলন মেলা এবং বেনাচিতি সংলগ্ন আকবর রোড ময়দানে ইসকন দ্বারা পরিচালিত রথযাত্রার উৎসব। দুর্গাপুরের এই রথযাত্রা উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজ্য তথা ভিন রাজ্যের বহু মানুষ শিল্পাঞ্চলে ভিড় জমান এই মহামিলন উৎসবে অংশগ্রহণ করতে। রাজ্য সরকার তথা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একনিষ্ঠ প্রয়াস ও স্থানীয় প্রশাসনের সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে প্রতিবছরই নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয় এই রথযাত্রার উৎসব।
এবছরও শিল্পাঞ্চলের যে তিনটি বড় রথযাত্রা উৎসব কমিটি রয়েছে তাঁদের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই মানুষজনকে স্বাগত জানাতে বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান সূচি শুরু হয়ে গিয়েছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শিল্পাঞ্চলের মানুষ এই কটা দিন রথযাত্রা উপলক্ষ্যে আনন্দে মেতে ওঠেন। কিন্তু প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মতো প্রতি বছরেই এই রথযাত্রারকে কেন্দ্র করে শিল্পাঞ্চলে পার্কিং মাফিয়াদের দাপট লক্ষ্য করা যায়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শিল্পাঞ্চলের যে তিনটি বড় রথযাত্রার উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তার প্রত্যেকটিতেই পার্কিং মাফিয়াদের দাপট দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের সজাগ চক্ষুর আড়ালে একশ্রেণীর সংগঠিত যুবক পার্কিং মাফিয়াদের সাহায্য করে বলে বহুদিন ধরেই অভিযোগ উঠছে। এবছরও বহু জায়গা থেকেই ইতিমধ্যেই পার্কিং সংক্রান্ত একাধিক অভিযোগ করেছেন সাধারণ দর্শনার্থী থেকে মেলায় আগত সাধারণ মানুষজন। তবে যে ঘটনাটি এবছর উল্লেখযোগ্য ভাবে সকলের নজর কেড়েছে তা হলো দুর্গাপুর ইস্পাত নগরী সংলগ্ন রাজীব গান্ধী স্মারক ময়দানে অনুষ্ঠিত চিত্রালয় ময়দানে রথযাত্রার মেলা প্রাঙ্গণের। সূত্র মারফত জানা গেছে চিত্রলয় মেলা ময়দানের চারিদিকের সরকারি ইস্পাত কর্তৃপক্ষের জায়গার ওপরে প্রতিবছরেই প্রায় ১৬ টি পার্কিং স্থল তৈরি হয়। সাইকেলের জন্য দশ টাকা, মোটরসাইকেল ও দু চাকা গাড়ির জন্য কুড়ি টাকা ও চার চাকার জন্য কোথাও ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত পার্কিং ফি নেওয়া হয় বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষজনের। স্বভাবতই আন্দাজ করা যায় প্রায় লক্ষ লক্ষ টাকা এই পার্কিং মাফিয়াদের দখলে চলে যায় কালো টাকা হিসেবে। এবছরও দুর্গাপুর চিত্রালয় মেলা ময়দানের চারিপাশের রাস্তার ধারে প্রায় ১৬ টি পার্কিং স্থল তৈরি হয়েছে। যেখানে পার্কিং মাফিয়াদের সাথে স্থানীয় যুবকদের কথা কাটাকাটি ও বাক বিতন্ডার মধ্যে দিয়ে পার্কিংয়ের জায়গা দখল করা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে এবছর সব থেকে গুরুতর অভিযোগ ছিল চিত্রালয় মেলা ময়দানের উল্টোদিকে কুমার মঙ্গলাম পার্কের দু’নম্বর গেটের সামনে একটি পার্কিং স্থলকে কেন্দ্র করে। একটি সূত্র মারফত জানা যায় তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থিত সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইব সংগঠন ও বাউরী সমাজের উদ্যোগে প্রতি বছরেই চিত্রালয় মেলা ময়দানের উল্টোদিকে কুমার মঙ্গলাম পার্কের ঠিক দু’নম্বর গেটের সামনে একটি পার্কিং স্থল তৈরি করা হয় অস্থায়ী রূপে। সেই পার্কিং স্থল থেকে উপার্জিত অর্থ পিছিয়ে পড়া সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইব ও বাউরী সমাজের উন্নয়ন প্রকল্পে লাগানো হয় বলে জানা গেছে। কিন্তু এবছর রথযাত্রার শুরুর প্রায় পাঁচ দিন আগে থেকেই ওই জায়গাটিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় চাপানউতোর।
বিশ্বস্ত সূত্র মারফত জানা গেছে বাউরী সমাজ ও সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইব সংগঠনের কর্মীবৃন্দরা যখন ওই পার্কিং স্থলটি ঘেরার কাজ করছিলেন তখন ইস্পাত নগরীর এক স্থানীয় তৃণমূল সমর্থক যিনি নাকি আবার তৃণমূলেরই কোন এক এসসি, এটি’র ছেলের নেতা বলে পরিচিত ব্যক্তি, স্থানীয় বি-জোন থানার আধিকারিকদের সাহায্যার্থে ওই পার্কিং স্থলটি অবরুদ্ধ করে রাখেন বলে অভিযোগ। এ নিয়ে বগত কয়েকদিন ধরেই প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দেন সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইব ও বাউরী সমাজের নেতৃত্ব। এরইমধ্যে গতকালকে সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইব ও বাউরী সমাজের প্রায় শতাধিক সমর্থক ওই বিতর্কিত জায়গায় জমায়েত হন পার্কিং মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার উদ্দেশ্যে। ঠিক তখনই রাজ্যের গ্রাম ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী তথা দুর্গাপুর শহরের অন্যতম বর্ষীয়ান নেতা প্রদীপ মজুমদারের কানে সে খবর যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রশাসন, দলের উচ্চ নেতৃত্ব ও সিডিউল কাস্ট সিডিউল ট্রাইব ও বাউরী সমাজের কর্মকর্তাদের সাথে কথাবার্তা বলেন। এবং ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তৎক্ষণাৎ প্রশাসন ও দলের একাধিক নেতা কর্মীদের কড়া নির্দেশ দেন অবিলম্বে ওই বিতর্কিত জায়গাটি সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইব ও বাউরী সমাজের লোকদের জন্য পার্কিং স্থল করে দেওয়ার জন্য। যেমন আদেশ তেমনি কাজ।
সূত্র মারফত জানা গেছে তৎক্ষণাৎ দুর্গাপুরের বি-জোন পুলিশ স্টেশনের পুলিশ কর্মী সহ স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা ছুটে যান ওই স্থলে এবং ওই পার্কিং স্থলটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সর্বসাধারণের গাড়ি রাখার জন্য। এ বিষয়ে সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইব ও বাউরী সমাজের একাধিক নেতৃত্ব ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, লাগাতার দশ দিন ধরে তাঁরা পার্কিং স্থল নিয়ে যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। কিন্তু আজ মন্ত্রী সচেষ্ট হওয়ায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হয়। এই উপলক্ষ্যে তাঁরা মন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের সকল ব্যক্তিত্বকে, সকল নেতৃত্বকে, তথা প্রশাসনের উচ্চকর্তাদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
সমস্যা সাময়িকভাবে মিটলো ঠিকই কিন্তু যেহেতু এটা তৃণমূলেরই দুই সংগঠনের ভেতরের বিরোধ তাই হয়তো তাড়াতাড়ি মন্ত্রীর ধমকেই কাজ হল। যদিও, শিল্পাঞ্চলে সারা বছর ধরে এই পার্কিং মাফিয়াদের দাপট যখন চলে তখন কেন প্রশাসন পুলিশ ও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব সেদিকে নজর দেন না? অন্যদিকে এইসব পার্কিং গুলি থেকে অবৈধ রূপে যে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজকার হয় তার হিসেব কি রাখা হয়? কারা নিচ্ছে ওই টাকাগুলি? কে হচ্ছে তাতে লাভবান? প্রশ্ন তুলেছেন দুর্গাপুরের সাধারণ মানুষজন। কখনো ইস্পাত কর্তৃপক্ষের জায়গা, কখনো দুর্গাপুর নগর নিগমের জায়গা, আবার কখনো আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের বিনা অনুমতিতে জায়গা দখল করে অবৈধ রূপে পার্কিং মাফিয়াদের দাপট প্রতিটি উৎসবেই লক্ষ্য করা যায় শিল্পাঞ্চলের বুকে। অবাক করার বিষয় হলো সবাই সবকিছু জেনেও চুপ করে কেন থাকছেন! তাহলে কি সর্ষের মধ্যেই ভূত রয়েছে? প্রশ্ন শিল্পাঞ্চলের সাধারণ মানুষের।






