eaibanglai
Homeএই বাংলায়আদিবাসীদের বর্গা জমি বিক্রির অভিযোগ মায়াবাজারের লোহা মাফিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে, তদন্তের নির্দেশ...

আদিবাসীদের বর্গা জমি বিক্রির অভিযোগ মায়াবাজারের লোহা মাফিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে, তদন্তের নির্দেশ জেলাশাসকের

নিজস্ব সংবাদদাতা দুর্গাপুরঃ- ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’! আর এই সত্যে’র বাস্তব দাদাগিরি বাম আমলে দুর্গাপুরের শহরতলীর অবাঙালি টোলায় যা ছিল, ঘাসফুলের জমানায় তার ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে শহেরর খাসতালুক থেকে ভিন পাড়ার বনেদি গ্রামগুলিতেও, আর তার নজিরও মিলছে হাতেনাতে।

শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরের একাধিক সরকারি জায়গা দখল করে ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণের ঢের অভিযোগ পড়েই রয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে। তা নিয়ে ইতিমধ্যেই কিছু কিছু নাড়াচাড়া শুরুও হয়ে গেছে। তারই মাঝে মায়াবাজারের ঐ কুখ্যাত লোহা মাফিয়ার এক ‘লবাব পুত্তুর’ তার পোষ্য শাগরেদদের পাশে নিয়ে দু-আঙুলে পিস্তল ঘুরিয়ে আদিবাসী গরিব বর্গাদারদের জমি দখলে বাধার মুখে প্রকাশ্যেই হুমকি দিচ্ছে, “আরে এইসব ভীতু বাঙালিরা কেউই তোদের বাঁচাতে আসবে না, ওদের দম্ জানা আছে। এই দুর্গাপুরে কোন মাইকা লাল আছে, আমাদের রুখবে। অফিসার, নেতা, টি এম সি-বিজেপি – সব কে মাল দিয়ে কিনে রেখেছি। হম্ লোগ যো বোলেগা – হিঁয়া ওহি হোগা।”

শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরকেই তাদের বাসস্থান হিসেবে প্রথম পছন্দ করেন আশেপাশের জেলা, রাজ্যের মানুষজনেরা। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর দালাল চক্র ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়েছে। গোটা শিল্পাঞ্চল জুড়ে সরকারি জমি, বনদপ্তরের জমি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার জমি ও পাট্টা দেওয়া জমিকে অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তুলছে একের পর এক আবাসন প্রকল্প। আজ অবধি দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল সন্নিকটে গরিব চাষীদের বর্গা জমি দখল করে আবাসন প্রকল্পর জন্য তা প্লটিং করে বিক্রি করার অভিযোগ ছিল না। কিন্তু এই অসাধ্য কাজকে করে দেখিয়েছেন দুর্গাপুরের প্রাক্তন ঐ লোহা মাফিয়ার পরিবারের লোকজনেরা। অর্থের জোরে, বাহুবলের জোরে ও বন্দুকের নল দেখিয়ে গরিব চাষির বর্গা জমি দখল করে নিয়েছে এই পরিবারের লোকেরা, বলে অভিযোগ। ইতিমধ্যেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ও পশ্চিম বর্ধমান জেলাশাসককে এ বিষয়ে লিখিতভাবে এই ঘটনার তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনও করেছেন দুর্গাপুরের পারুলিয়া গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা।

উল্লেখ্য, অভিযোগ পত্র অনুযায়ী ও স্থানীয় সূত্র মারফত জানা গেছে দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর উত্তর প্রান্তে পারুলিয়া গ্রাম যাওয়ার মূল রাস্তার পাশেই, পারুলিয়া মৌজা অন্তর্গত প্রায় ৮ একর জায়গা জুড়ে এখন চলছে বিতর্কিত একটি আবাসন প্রকল্পের কাজ। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের মায়া বাজারের প্রাক্তন কুখ্যাত লোহা মাফিয়া রাম পদারথ রামের পুত্র হীরা কুমার রাম ও পদারথের স্ত্রী শৈলী দেবীর নাম খতিয়ান নম্বর ১০৫১ ও খতিয়ান নম্বর ১০৫২, ১২ টি দাগে মোট ৮.৩৯ একর জমি কেনা ছিল। যার প্রমাণ পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদিত বাংলার ভূমি সরকারি ওয়েবসাইটে ০৯/১০/২০১৮ সকাল সাড়ে নটা অবধি। ওই একই সময়ে ১০৫১ ও ১০৫২ নম্বর খতিয়ান মিলিয়ে মোট ৬.৪৮ একর জায়গা বর্গা জমি হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সেই জমিতেই দুইজন বর্গাদার ও ছিল বলে জানা গেছে। ওই জমির দাগ নম্বর ১৮১ দাগে ৬.৪৮ একর জায়গা বর্গাদার বাবুলাল যাদব (পিতা রামসেবক যাদব) ও বিশু হেমব্রম (পিতা বলাই হেমব্রম) এর নামে রেকর্ড ছিল গত অক্টোবর মাসের ২০১৮ সাল অবধি। কিন্তু, স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ২০১৯ এর শেষের দিকে উক্ত দুজন বর্গাদারের নাম হঠাৎই কোনো এক যাদুমন্ত্রে উধাও হয়ে যায় ১০৫১ ও ১০৫২ নম্বর খতিয়ানের নথীকৃত সরকারি রেকর্ড থেকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, তৎকালীন বি.এল.আর.ও, এবং ডি.এল.আর.ও প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা ঘুষের বিনিময়ে নাকি গরিব আদিবাসী ওই বর্গাদারদের নাম রেকর্ড থেকে মুছে প্রাক্তন কুখ্যাত লোহা মাফিয়া রাম পদারথ রামের স্ত্রী ও পুত্রের নামে রেকর্ড করে দিয়েছিলেন।

এরপর থেকেই জোর কদমে ওই জমিগুলিকে প্লটিংয়ের মাধ্যমে ভাগ করে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল ও তার আশে পাশের বহু মানুষকে বিক্রি করাও শুরু করেন এই প্রাক্তন কুখ্যাত লোহা মাফিয়া পরিবারের লোকজনেরা। শুধু তাই নয় জমি বিক্রি ও প্লটিংয়ের কাজ যাতে দ্রুত সম্পূর্ণ করা যায় সেই জন্য ওই প্রাক্তন লোহা মাফিয়া পরিবারের লোকজনেরা একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে দ্রুত জমিগুলির বিক্রিরও ব্যবস্থা করেন। দুর্গাপুরের প্রাণকেন্দ্র সিটি সেন্টারে অবস্থিত বেঙ্গল অম্বুজার ৩১ নম্বর স্ট্রিটে অবস্থিত ‘রয়েল হোমস’ নামক একটি বিতর্কিত সংস্থা ওই জমি গুলি প্লটিং করে বিক্রি করা শুরু করে বলে জানা গেছে। এই বিষয় ‘রয়েল হোমস’র একজন কর্মকর্তা আনন্দ মল্লিককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তারা ওই জমিগুলিকে বিক্রি(রিসেল) করছেন প্রতি কাটা পাঁচ লক্ষ টাকা করে, বাড়ি বানানোর জন্য। দ্রুততার সাথে আসানসোল দূর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদ ও দুর্গাপুর নগর নিগমের কাছে জমা পড়তে শুরু হয় বিল্ডিং প্ল্যানের অনুমোদন ও বাড়ি বানানোর জন্য এন ও সি নেওয়ার। ইতিমধ্যেই এই দুই সংস্থা থেকে বহু আবাসনের জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়ে গিয়েছে বলে জানা গেছে একটি সূত্র মারফত। এই ছাড়পত্র দেওয়ার নেপথ্যে উন্নয়ন সংস্থার পরিকল্পনা বিভাগের এক চশমাধারী আধিকারিক মোটা টাকা পকেটে পুরেই এইসব বেআইনি নির্মানের ঢালাও ছাড়পত্র বিতরন করে গেছেন, বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

এই ঘটনার কথা জানাজানি হতেই নড়ে চড়ে বসে স্থানীয় গ্রামের মানুষজন ও ওই গরীব আদিবাসী বর্গাদার পরিবার গুলি। স্থানীয় গ্রামবাসীদের সহায়তায় গরিব আদিবাসী পরিবার গুলি দ্রুততার সাথে তাদের বর্গা জমি এলাকাটি তারকাটা দিয়ে ঘিরে ফেলেন এবং তাতে ছোট ছোট সাইনবোর্ড দিয়ে লেখা রয়েছে এই জমি বিক্রি করা যাবে না। ওই গরীব আদিবাসী বর্গাদার পরিবার গুলির অভিযোগ তারা কোন মতেই বর্গাদারের নাম তোলার জন্য বি.এল.আর.ও বা ভূমি রাজস্ব দপ্তরে যাননি। কে বা কারা কিভাবে তাদের নাম বাদ দিয়ে জমিটির রেকর্ড করে দিয়েছে তা তারা জানেন না। স্থানীয় ওই আদিবাসী পাড়ার মানুষজনের অভিযোগ প্রাক্তন কুখ্যাত লোহা মাফিয়া রাম পদারথ রামের পুত্র হীরা রাম কয়েকদিন আগেই আগ্নেয়াস্ত্র সহ ওই পরিবারগুলিকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হুমকি দিচ্ছে। ভীত সন্ত্রস্ত ওই গরিব আদিবাসী পরিবার গুলি এখন প্রানের ভয়ে লুকিয়ে বসবাস করছেন বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে।

এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে – যারা মোটা টাকার বিনিময়ে ওখানে আবাসন গড়ার জন্য জমি কিনেছেন ও বাড়ি বানাচ্ছেন, তাদের। অদূর ভবিষ্যতে ওই জায়গার কি পরিনতি হয় সেটা ভেবেই এখন সিন্দুরে মেঘ দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। সব থেকে বেশি বিপদের সম্মুখীন হলেন সেইসব ব্যক্তিরা – যারা ঐ সব এলাকায় ঘরবাড়ি জন্য জমি কিনেছেন। যদি সত্যিই রেকর্ডে কারচুপি করে ওই জমি হস্তান্তর হয়ে থাকে, তাহলে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করে নিজের স্বপ্নের বাসস্থান করার উদ্দেশ্যে যারা জমি নিয়েছেন ওই প্রকল্পে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকেই যাচ্ছে। একটি সূত্র মারফত জানা গেছে পশ্চিম বর্ধমান জেলার জেলাশাসকের কাছে এই অভিযোগ পৌঁছানোর পরেই জরুরী ভিত্তিতে তিনি এই অভিযোগের যথাযথ তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগের আধিকারিকদের। আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান কবি দত্ত জানান, তাদের কাছে এখনো অব্দি এইরকম কোন অভিযোগ এসে পৌঁছায়নি তবে নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুতর বিষয়। তিনি বলেন, “যদি এইরকম কোন লিখিত অভিযোগ আমাদের কাছে আসে, তাহলে অবিলম্বে তা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এই তার দায়সারা আশ্বাস।

একটি অসমর্থিত সূত্র মারফত জানা গেছে জেলাশাসক যে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগের আধিকারিকদের, সেই তদন্তে জানা গেছে সত্যিই রেকর্ডে কারচুপি করা হয়েছে। কোনরকম কাগজপত্র ছাড়াই বর্গাদারদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবেই। এ বিষয়ে খুব শিগ্র ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগ একটি রিপোর্ট জেলাশাসককে দেবেন ওই বর্গাদারদের নাম পুনর বহাল করার সপক্ষে, বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয় ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, “এই জমি সংক্রান্ত রেকর্ডের কারচুপি করার জন্য দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবেই।” এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments