eaibanglai
Homeএই বাংলায়সিন্ডিকেটে যোগান দিতেই কি মরল রানীগঞ্জের কয়লা চোর মজুরেরা ?

সিন্ডিকেটে যোগান দিতেই কি মরল রানীগঞ্জের কয়লা চোর মজুরেরা ?

মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের তদন্তের মাঝেই কি ফের সক্রিয় কয়লা পাচার চক্র ? ফের ‘প্যাড’ ? থানায় থানায় ডিপো ? আর সেই সব ‘ডিপো’র খাঁই মেটাতে গিয়েই কি রানীগঞ্জের খাদানের অন্ধকার সুরঙ্গে বলি তিন তিনটি তাজা কয়লা মজুর ?

আরো অবাক করার মতো ঘটনা মৃত কয়লা চোরদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে ‘সহমর্মী’ বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল ওই তিন কয়লা মজুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছেন রাষ্ট্রায়ত্ব খনি সংস্থা ইসিএল কেই। তার কথায়, “রাজ্য সরকার কাজের ব্যবস্থা করেনি, তাই পেটের দায়ে দু’ঝুড়ি কয়লার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরা এমন বিপজ্জনক সুড়ঙ্গে ঢোকে। এটাই ওদের জীবন ধারণের একমাত্র পথ। কিন্তু, ইসিএলের খাদানের ভেতর ঢুকে এরা কয়লা কাটছিল, তার দায় যেমন স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের, তেমনই সমানভাবে ইসিএলেরও।” তার দাবি, ” এখনো পর্যন্ত আটটি দেহ উদ্ধার হয়েছে। তিনটি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে বাকি দেহ পুলিশ, তৃণমূল আর ইসিএল লোপাট করেছে। সব জানাব কয়লা মন্ত্রকে।”

রানীগঞ্জের এগরা-নারানকুড়ির বৈধ খাদানে কয়লা চুরি করতে গিয়ে ধসে চাপা পড়ে মারা যায় তিনজন-সুরজিৎ সেন, সমীর বাউরি আর দীনেশ রুইদাস। অগ্নিমিত্রার দাবি, “চাপা পড়ে আছে আরো দেহ। অন্ততঃ সাত জন মারা গেছে।” মৃত শ্রমিকদের সকলেই কিন্তু এগরা-নারানকুড়ির বাসিন্দা ছিল না। এদের একজন সমীরের বাড়ি জামুড়িয়ার পরিহারপুরে। অর্থাৎ, নিছক পেটের দায়ে খাদানের সুরঙ্গে ঢুকে পড়া মজুরেরা কয়লা কাটতে ঢুকে গেল, ব্যাপারটা ঠিক এরকম কি ? এটা যে সংগঠিত অপরাধ তার প্রমানই হচ্ছে, আশেপাশের ব্লক থেকে লোকবল যোগাড় করে সরকারি খাদানের সুড়ঙ্গেই কয়লা কাটা চলছিল বলে অভিযোগ। তাহলে, তাদের সর্দার বা ‘মাথা’ নিশ্চয় কেউ রয়েছে, বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা।

এইসব হতদরিদ্র কয়লা কাটা মজুদদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাদানে কয়লা কেটে কেউ কেউ খোলা বাজারেও বিক্রি করে ২০০ টাকা কুইন্টাল পিছু দরে। কখনো এদের ক্রেতা ছোটখাটো হোটেল, রেস্তোরাঁ বা ইটভাটা। এ পর্যন্ত ‘গল্পটা’ একরকম। কিন্তু, মুদ্রার অন্য পিঠেই রয়েছে নতুন করে কয়লা পাচারের সংগঠিত চক্রের সক্রিয় হওয়া। সত্যিই কি পুরুলিয়ার কয়লা- কিং অনুপ মাঝি ওরফে লালা’র পর শিল্পাঞ্চলে কয়লা পাচারের নতুন কোনো সিন্ডিকেট সক্রিয় হচ্ছে ?

গত ১ এপ্রিল বর্ধমানের শক্তিগড়ে কয়লা মাফিয়া কাম বিজেপি ক্যাডার রাজু ঝা হত্যার পর পরই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়, রাজু স্থানীয় রানীগঞ্জ, দুর্গাপুর, বক্তারনগর, অন্ডাল, পাণ্ডবেশ্বরের কয়েকজনকে নিয়ে কোলিয়ারি সাইডিং-এ নতুন করে কয়লা পাচার চক্র শুরু করেছিল। তার অভয় ছিল, “আমি বিজেপি করি। আমার সাথে কারবারে এলে ভয়ের কিছু নেই।” তাই, এলাকার পুরনো কিছু কয়লা কারবারিকে নিয়ে রাজু শুরু করে ‘ডান্ডা ট্যাক্স’ নামে নতুন কায়দায় কয়লার তোলাবাজি। কিন্তু, আচমকা, রাজু ঝা হত্যার সাথে সাথে তাতে ক্ষণিকের ছেদ পড়লেও, পাণ্ডবেশ্বরকে ঘিরে ফের শুরু হয়েছে ‘ডান্ডা ট্যাক্স’। পাশাপাশি,ওপরতলার কিছু পুলিশ ও গোয়েন্দা আধিকারিকদের ‘খুশি করে’ নাকি নতুন করে কয়লা পাচারের একটি সংগঠিত চক্রের পান্ডা হয়েছে কোনও এক ‘কান্তা শর্মা’ নামক আরেক অপরাধী বলে অভিযোগ । পুলিশেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, “বারাবনি, জামুড়িয়া, সালানপুর থানা এলাকাগুলিতে কাজ শুরু করেছে ‘কান্তা’। তার জন্য ওই সব এলাকার হার্ড কোক, গুল ফ্যাক্টরি গুলির কাছ থেকে তিন লক্ষ টাকা করে অগ্রিমও নিয়েছে সে।” জানা যায়, এরকম ৩০০ টি ফ্যাক্টরি রয়েছে ‘কান্তা’র তালিকায়। অর্থাৎ, ন’কোটি টাকার অগ্রিম বুকিং। এরপর গাড়ির পিছু ৯০ হাজার টাকা কয়লার ‘প্যাড’। অভিযোগ, সাম্প্রতি ‘কান্তা’র নামে শিল্পাঞ্চলের একটি থানায় অভিযোগ দায়ের হওয়ার পর সেই দর নাকি ৭০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। প্রশ্ন, তাহলে কি রানীগঞ্জের খাদানে মৃত কয়লা মজুরেরাও সেই ‘কান্তা শর্মা’র জন্যই জীবনের বাজি রেখে কয়লা কাটতে গেছিল ? এই প্রশ্নের জবাব মিলেনি এখনো। আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের ডেপুটি কমিশনার (সেন্ট্রাল) কুলদীপ সেনাওয়াল জানান, “অবৈধভাবে কয়লা কাটতে গিয়ে কয়েকজন চাপা পড়ে মারা গেছে। তিনটি দেহ উদ্ধারও হয়েছে।”

কিন্তু, সিন্ডিকেট চক্র নিয়ে পুলিশের মুখে কুলুপ। প্রাক্তন সাংসদ, মন্ত্রী বংশ গোপাল চৌধুরী এখন পশ্চিম বর্ধমান জেলার সিটুর সভাপতি। তিনি বলেন, “গরীব মানুষের রোজগার নেই, চাষবাস নেই, খাবে কি? তাই তারা বাধ্য হয়ে খাদানের পথে যায়। কিন্তু, যারা আসল মুনাফা কামায় তারা থাকে ওপর তলায়, অনেক ওপর তলায়।” তার দাবি, “এতগুলো লোক চাপা পড়ে মরে গেল, ইসিএল বা পুলিশ কি শুধু দেহ ময়নাতদন্তের পর হাত ধুয়ে ফেলবে ? যদি কোনো চক্র সক্রিয়, তবে তাদের খুঁজে বের করতেই হবে।”

ঘটনার প্রসঙ্গে এলাকার বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিন মজুরদের দুর্দশার কথা সামনে এনেছেন। তার দাবি, “এর দায় নিতে হবে কেন্দ্র সরকারকেই। কারণ, যা ঘটেছে তা কেন্দ্রীয় মালিকাধীন সংস্থা ইসিএলের ভেতরেই ঘটেছে।” তিনি বলেন, “দু’বছর ধরে ১০০ দিনের কাজের টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্র। গরীব মানুষ খাবে কি? সামনেই কয়লার পাহাড়। গাঁইতি চালালেই দু’মুঠো ভাত কাপড় জুটবে, তাই চলে যাচ্ছে। ইসিএলের নিরাপত্তারক্ষীরা কি করে ? ওদেরও কি ইন্ধন নেই ?”

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments